ভাতে ঋতুস্রাবের রক্ত মেশানোর বিচিত্র রেওয়াজ স্বামী বশীকরণে
এ মাসের শুরুতে সিঙ্গাপুরে ৪১ বছরের এক নারীকে আটক করে সেদেশের পুলিশ। অভিযোগ সে তার ফ্লাটে বসবাসকারী সবার ভাতের মধ্যে তার ঋতুস্রাব মিশিয়ে দিয়েছিল। আদালতে তোলার পরে রাষ্ট্র পক্ষের উকিল জানন ফিলিপাইনের নাগরিক ক্যানারেস রোভেনা ওলা নামের ওই নারী দীর্ঘদিন ধরে তার ফ্লাটে বসবাসকারী অন্য প্রতিবেশীদের খাবারের মধ্যে তার নীজের ঋতুচক্রের রক্ত ও প্রসাব মিশিয়ে আসছিলেন। পরে আদালতে সে তার দোষ স্বীকার করে নেয়। এই নোংরা অপরাধের জন্য তার এক বছরের জেল হয়েছে। গত এক বছরে দেশটিতে এরকম আরও একটি ঘটনা ঘটেছে ।
২০১৮ সালে হংকংকে ‘সেনজিয়ান হট পট’ নামে একটি খাবারের দোকানে খাবারের মধ্যে স্যনিটারি ন্যকপিন খুঁজে পান এক নারী। নেলি নামে ওই নারী পরে সেই প্যাডের ছবি ফেসবুকে আপলোড করলে হই হই রব ওঠে হংকং জুড়ে। পরে সেই রব মেইন ল্যন্ড চায়না পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বন্ধ হয়ে যায় চেইন রেস্তরাটি। নেলি ওই দোকানের বিরুদ্ধেএক লাখ মার্কিন ডলারের ক্ষতিপুরণ মামলা করেন।
কুয়ালালামপরে আমার সহকর্মি শিবা জানান ২০১৭ সালে মালয়শিয়ার জোহরে তিনটি খুবই জনপ্রিয় চিকেন রাইস শপ বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। সারাদিন ওই দোকানগুলোতে ক্রেতাদের লাইনে দাড়িয়ে চিকেন রাইস কিনতে দেখেছেন তিনি। দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে জনশ্রুতি রয়েছে যে তাদের পরিবেশিত খাবারের মধ্যে সেনিট্যারি ন্যকপিন পাওয়া গেছে। একাধিক ক্রেতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দোকানগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়।
পৃথিবীর সব দেশেই বয় বেয়ারারা বদমেজাজী কাস্টমারদের খাবারে থুথু দেয় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু খাবারের মধ্যে ঋতুস্রাব ও প্রশাব মেশানোর ঘটনাটি থমকে দিল আমাকে। কেনই বা ওই নারী এ কাজটি করেছেন। আর কেনই বা দেশগুলোতে খাবারের মধ্যে স্যনিট্যারি ন্যকপিন পাওয়া যাচ্ছে । বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে যেয়ে এক অদ্ভুতরে রেওয়াজ খুঁজে পেলাম। আর তা হচ্ছে ‘নাসি কাংকাং’ বাংলায় অর্থ করলে দাড়ায় ‘ভালবাসার ভাত’।
মালয়শিয়া ইন্দোনেশিয়ায় ভাতকে নাসি বলে। যেমন নাসি লেমাক, নাসি আয়াম ইত্যাদী ইত্যাদী। নাসি লেমাক হচ্ছে ভাতের সঙ্গে এক ধরণের শুটকির চাটনি, নাসি আয়াম হচ্ছে ভাতের সঙ্গে মুরগীর মাংস। আর নাসি কাংকাং হচ্ছে ‘ভাতের সঙ্গে ঋতুস্রাব’। গোপনে গোপনে কয়েক হাজার বছর ধরে মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও হংকংয়ে এই নাসি কাংকাংএর প্রচলন রয়েছে। হাজার বছর ধরে এইসব দেশগুলোর অনেক পুরুষরা তাদের সঙ্গিনী অথবা স্ত্রীর রান্না করা ভাতের সঙ্গে তাদের ঋতুস্রাব খেয়ে আসছেন।
নাসি কাংকাং মুলত এক ধরনের যাদুমন্ত্রে তৈরী ভাত। হাজার বছর ধরে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নারীরা তাদের পছন্দের পুরুষদের খাইয়ে আসছেন। এটিকে অন্যকথায় স্বামী বশীকরণের অষুধ বলা যেতে পারে। এর উৎপত্তি বোমোহ সাস্কৃতি থেকে। ১০০ বছর আগ পর্যন্ত বোমহরা ছিলেন এসব দেশগুলোর সবচেয়ে বড় ডাক্তার। এসব দেশে এ্যলোপ্যাথি ডাক্তার আসার আগে তারাই ছিল দাপুটে ডাক্তার। আসলে তন্ত্রসাধক বা ওঝাঁ। মালয়শিয়াতে বোমহ মানে ওঁঝা বা কবিরাজ । তাদের কাজ ছিল ঝাড়ফুঁক দেওয়া, দাওয়াই বানানো। মূলত ফুঁ মন্ত্র। এখনকার সময়ে এটাকে ব্লাক ম্যজিক বলা হলেও এই দেশগুলোর একটি বড় অংশই ঝাড় ফুঁক তাবিজ কবজে বিশ্বাস করে এখনও। এখনও তারা চর্চাও করে এটি । তবে গোপনে।
অফিসের বসদের মোহবিষ্ট করে রাখা, স্বামীকে বশে রাখা, কাস্টমারদের ধরে রাখা,প্রেমিকদের ধরে রাখা এসব কাজের জন্যেই এই নাসি কাংকাং। বোমাহদের কাছ থেকে আবিস্কৃত এ দাওয়াই শুধু নারীরা ব্যবহার করতে পারে তাদের মনবাসনা পূর্ণ করার জন্য। এসব দেশের নারীদের অনেকেরই বিশ্বাস এতে কাজ হয়। এটি বিশ্বাস করেনেএসব দেশগুলোর পুরুষরাও। মালয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানে যাদুমন্ত্র নিষিদ্ধ হলেও এ দেশ দুটিতে গোপনে গোপনে এটির প্রচলন সর্বজনবিদিত।
ধরুন অফিসের কোন নারী চিন্তা করলেন বসকে বশ করতে হবে। নো প্রবলেম। ওই নারী একদিন বাসায় দাওয়াত দিয়ে তাকে তার ঋতুস্রাব মিশ্রিত ভাত খাইয়ে দিলেই হল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না ওই নারীর। সে যা চাইবে, যেভাবে চাইবে বস সেভাবেই করবেন সবকিছু। তরতর করে পদন্নতি হবে ওই নারীর।
স্বামী বেয়ারা? এদিক সেদিক মুখ দেয়? পরনারী দেখলেই চোখ চকচক করে ওঠে। নো প্রবলেম। তাকে একদিন ঋতুস্রাব মেশানো ভাত খাইয়ে দেওয়া হলো । এরপর ওই স্বামী তার জীবদ্দশায় অন্য কোন নারীর দিকে তাকাবেই না। ওই নারীর কথায় ্ওঠবস করবেন তিনি।
দোকানে কাস্টামার নেই? নো প্রবলেম। যে কাস্টমারই আসুক তাদেরকে ঋতুস্রাব মেশানো খাবার খাইয়ে দেওয়া হোক । সে বারবার আসবে। এধরণের চিন্তা ধ্যনধারণা থেকে হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে এই দেশগুলোতে।
কী ? লেখাটি পড়েই কি গা গুলিয়ে উঠছে? নাসি কাংকাং খেতেই বা কেমন? কীভাবে রান্না করা হয়? কবে থেকে এর প্রচলন? আগ্রহ থেকেই আরও বিশদ গবেষণা করে জানতে পারলাম দেশভেদে নাসি কাংকাং এর ভীন্ন নামও রয়েছে। ইংরেজীতেও এটিকে বলা হয়ে থাকে ক্রটস রাইস। মানে উরুসন্ধীর সংযোগে তৈরী ভাত। ইন্দোনেশিয়ায় এই ভাতের নাম নাসি টাংগাস। শুধু এখানেই নয়, এই ভাতের প্রচলন রয়েছে ক্যরিবিয়ান দেশ ত্রিনিনাদেও। সেখানে এর নাম সোয়েট রাইস।
নাসি কাংকাং রান্নার পদ্ধতিও বড় অদ্ভুত। দেশভেদে এটি রান্নায় বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তবে প্রতিটিতেই ঋতুস্রাব মেশানোর বিষয়টি কমন। গবেষণা থেকে জানা গেছে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়ায় নাসি কাংকাং বা নাসি টাংগাস রান্না করতে হলে নারীরা পিরিয়ডের দ্বিতীয় দিনটি বেছে নেন। সেদিন তিনি গোসলের পানি একটি পাত্রে ধারণ করে সেটি দিয়ে ভাত রান্না করেন। এরপর গরম ভাত একটি প্লেটে তুলে সেই ভাত থেকে যখন ভাঁপ উঠে সেসময়ে উলঙ্গ হয়ে দু পা ফাঁক করে ভাপ ওঠা ভাতের ওপরে শরীরের গোপন অঙ্গটিকে স্পর্শ করেন। এরপর যখন শরীর থেকে স্রাবের রক্ত ঝড়ে তখন সেই ভাতের সঙ্গে তরকারী বা মাংস মিশিয়ে গরম গরম পরিবেশন করতে হয় পছন্দের পুরুষকে। অন্যদেশগুলোতে ঋতুস্রাবের সঙ্গে শরীরের ঘাম এবং পায়ের কাটা নখ, শরীরের গোপন অংশের চুল মেশানোর কথাও শোনা গেছে। ভাপ ওঠা ভাত ও স্রাবের সংমিশ্রনের মোক্ষম সময়ের ওপরে নির্ভর করে এর কার্যকারিতা।
একবার ওই ভাত পছন্দের পুরুষরা খেলে আর কোন টেনশন নেই ওই নারীর। সে যা বলবে যা চাইবে তাই করবে তার পুরুষ। এক কথায় বশিকরণ বলা যেতে পারে।
জানতে পারলাম দেশগুলোতে নাসি কাংকাং এতই জনপ্রিয় যে এ নামে বেশ কটি রোস্তারা খুঁজে পাওয়া গেল খোদ মালয়শিয়াতে। এছাড়াও প্রতি বছর মালয়শিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় একাধিক ড্রামা সিরিয়াল বা সিনেমা নির্মিত হয় যার মূল প্রতিপাদ্য ‘নাসি টাংগাস’ বা ‘নাসি কাংকাং’। এক বাক্যে ‘পুরুষ বশীকরণ তাবীজ’।
No comments